হাওরের কৃষি- ধান রোপণ থেকে শুরু করে পরিচর্যা, কাটা, মাড়াই, ঝাড়াই, শুকানো সব কাজই সম্পূর্ণ প্রকৃতির মর্জি মেজাজের উপর নির্ভর করে। প্রায় ৮ হাজার বর্গ কিলোমিটার আয়তনের হাওর এলাকায় প্রায় ১৯.৩৭ মিলিয়ন লোক বসবাস করে এবং মোট ৩৭৩টি হাওর রয়েছে;। মোট চাষযোগ্য জমির পরিমাণ ০.৭৩ মিলিয়ন হেক্টর, বছরে ধান উৎপাদন- ৫.২৩ মিলিয়ন টন। জিডিপি’তে হাওরের অবদান ০৩% এবং এর ২৫% আসে কৃষি থেকে। আগাম বন্যায় বছরে ক্ষতি-০.৩৩ মিলিয়ন হেক্টর, যার অর্থ মূল্য-৩.৪৮ মিলিয়ন টাকা। এ ক্ষতি জাতীয় কৃষির প্রায় ৩%।
হাওরের প্রকৃতি মতি গতি একটু বিগড়ে গেলেই সব কিছুর ছন্দ পতন ঘটে লন্ড ভন্ড হয়ে পরে। এবছর প্রচন্ড খরা সত্বেও সব কিছু ঠিক ঠাক মতো চলছিল। চৈত বৈশাখ মাসের প্রথম দিকে বৃষ্টি না হওয়ায় উজান থেকে নেমে আসেনি অকাল বন্যার সর্বগ্রাসী পানি। এ সুযোগে কৃষক রাত দিন পরিশ্রম করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নীচু এলাকার জমির ধান কেটে স্তুপ করে রেখেছে।
কবি গুরু সম্ভবত চলন বিলের পাড়ে বসে ” সোনার তরী’ কবিতাটি লিখেছিলেন। চলন বিলের প্রকৃতি, বর্ষার আগমন ও ধান কাটার বিষয়টি কবির মনে গভীর দাগ কেটেছিল। হাওরাঞ্চল ও চলন বিলের প্রকৃতি ও পরিবেশ প্রায় অভিন্ন। বর্তমানের অবস্থার বাস্তব প্রতিফলন সোনার তরী কবিতার প্রতিটি ছন্দে ছন্দে।
গগণে গরজে মেঘ ঘণ বরষা।
কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা।
রাশি রাশি ভারা ভারা ধান-কাটা হল সারা,
ভরা নদী ক্ষুর ধারা খরপরশা-
কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা।।
যেকোন সময় নেমে আসতে পারে মহা দুর্যোগ অকাল বন্যা। অন্য জমির ধানও তাঁরা কাটতে ব্যস্ত। কোন বিপদ সংকেত না থাকলে হাওরবাসি কৃষক সাধারণত এক সাথে ধান কাটে, মাড়াই, ঝাড়াই ও শুকানোর কাজ চালায়। ধান শুকানোর জন্য সূর্য়ের আলোই একমত্র ভরসা। চব্বিশ ঘন্টায় তাঁদের কর্মসময়। কিন্তু এবার, বৈশাখ মাসের ২০ তারিখের পর হঠাৎ করেই অকাল বন্যা আঘাত করে। দ্রুত কৃষক ধান কেটে নিয়েছে, ধান তলিয়ে যায়নি সত্যি। তবে কাটা ধান স্তুপ করে রেখেছে কান্দা বা উচুঁ স্থানে। চারিদিকে পানি, ঝড় বৃষ্টির মাঝেও এসব ধান পাহারা দিতে হচ্ছে। মাড়াই করা ধান প্রয়োজনীয় রোদ্দুর, সূর্য়ের আলোর অভাবে শুকাতে পারছে না । অহরহ, একনাগাড়ে বৃষ্টি হচ্ছে। পর্যাপ্ত শুকনো জায়গা নাই, যেখানে ধান শুকাবে, মাড়াই করবে। ধান শুকানোর ”খলা” / ত্রেশিং ফ্লোর সবই পানির নীচে। ভিজা ধানে চারা গজাচ্ছে। সিদ্ধ ধান পঁেচ গন্ধ ছড়াচ্ছে। রোগ বালাইও বৃদ্ধি পেয়েছে। ধানের খড় পচেঁ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এ খড়ই হচ্ছে বর্ষায় গবাদি পশুর একমাত্র খাদ্য এবং সারা বছর রান্নার জ্বালানী হিসাবে ব্যবহৃত হয়। রোদের অভাবে সব কিছু পচেঁ গলে চারিদিক বিশ্রি অবস্থা।
প্রতি বছরই হাওরবসিকে এ রকম দুর্যোগ মোকাবেলাা করতে হয়। কিন্তু বৈশাখ মাসে ঢলের পানি কেন হাওরে প্রবেশ করবে? এ পানিকে হাওরে প্রবেশ করতে না দিয়ে ভাটিতে নামিয়ে দিতে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা খরচ করে বাঁধ নির্মাণ করা হয়। পানিকে যদি দুই সপ্তাহ পর্যন্ত আটকিয়ে হাওরে প্রবেশে করতে না দেয়া হয়, তবে কৃষক এ সময়ে ধান কেটে ঘরে তুলতে পরে। বাঁধ নিমার্ণে বড় ধরণের শুভংকরের ফাঁকি থাকে। এ বছরও হয়েছে, ধান তলিয়ে যায়নি, তবে নষ্ট করছে। নিরবতার সুযোগে অনিয়ম চাপা পড়েছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে হাওরের প্রতিটি গ্রামে বহুমুখী ব্যবহার উপযোগী উঁচু , পাকা ভিটা তৈরী করা যেতে পারে। যেখানে কৃষক ধান সংরকক্ষণ, মাড়াই, ঝাড়াই, শুকানোর কাজটি করবে। হাওর মহা পরিকল্পনায় আট বছরে ২ কোটি ৮৫ লক্ষ টাকা ব্যয়ে ২ হাজার ৪০ টি ড্রাইয়ার কেনার কথা। আমার ধারণা, ড্রাইয়ার হাওর এলাকায় উপযোগি হবে না, ব্যয় বহুল হবে, লক্ষ লক্ষ মন ধান শুকানাও সম্ভব না। একসময় বলা হতো, ধানই ধন। কৃষি পণ্যের মধ্যে ধানের মূল্য ( চালের মূল্য কিন্তু নয়) সবচেয়ে কম। সমপরিমাণ ধান দিয়ে সমপরিমাণ কোন কিছুই বাংলাদেশে পাওয়া যায় না। আধা মরা ধান চাষী হাওরবাসি কৃষক এক মুটো রোদ্দুরের জন্য আল্লার কাছে প্রার্থণা করা ছাড়া কি-ই বা করার আছে ?
—–ড. নিয়াজ পাশা
এ সান অব সয়েল অব হাওর
(হাওর ভূমিপুত্র), কৃষি প্রকেীশলী। niazpasha@yahoo.com; ০১৭২৭ ০৭৪ ৫৮৪
This is a nice post.