কৃষিবিদ মো. তারিক হাসান
আমাদের দেশের চাষযোগ্য সীমিত পরিমাণ জমির তুলনায় প্রায় ৩-৪ গুন সংখ্যক মানুষের খাদ্য চাহিদা মেটাতে প্রয়োজন একর প্রতি ফলন বৃদ্ধি। উৎপাদন বৃদ্ধির মুখ্য প্রযুক্তি হিসেবে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের আবশ্যকীয় । ফলন বৃদ্ধির একাদর্শি দৃষ্টিভঙ্গি কৃষকের দারিদ্রতা ও অল্প শিক্ষার ফলস্বরূপ রাসায়নিক কৃষি উপকরণের অতি ও অসম প্রয়োগ ঘটে যাচ্ছে। যার ফলে জমির উপর বিভিন্নমুখী ক্ষতিকর প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে, যা প্রতিনিয়ত পরিবেশ দূষিত করছে। এছাড়া বছরে প্রায় ১৫-২০ লক্ষ টন খাদ্য শস্য পোকামাকড় দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ফসল সংরক্ষণের গুরুত্ব বিবেচনায় কীটনাশকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার ঘটে। প্রায় ৫০০ কীটপতঙ্গ নিজেদের দেহে কীটনাশক প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলেছে। প্রচলিত রাসায়নিক কীটনাশক পরিবেশের জন্যও ক্ষতিকারক বলে প্রমাণিত হয়েছে। এই অবস্থায় জৈব কীটনাশকের ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা ও উপযোগীতা গুরুত্বপূর্ন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
আমাদের পুঁথিপত্রে ২০০০ বছর আগেই নিমকে বায়ুশোধনকারী ও কীটনাশককারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। রাসায়নিক কীটনাশকে যে সব পোকা মরে না, এরূপ ২০০ রকমের পোকাও নিমে পর্যুদস্থ হয়। জৈব কীটনাশকের উৎস হিসেবে ‘নিম’ অত্যন্ত মূল্যবান বৃক্ষ হিসেবে আধুনিক বিজ্ঞানেও স্বীকৃত। রাসায়নিক কীটনাশকে সাধারণতঃ এক ধরনের বিষাক্ত পদার্থ বিদ্যমান থাকে যা মানুষ ও পরিবেশের জন্য অনিষ্টকর। কিন্তু নিম গাছের বিভিন্ন নির্যাস থেকে প্রস্তুত কীটনাশকে প্রায় ১২৭ টির ও অধিক উপাদানের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। যা রোগ বালাই দমনে বিশেষ কার্যকর ও পরিবেশ বান্ধব। এ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য ও তত্ত্ব বিশ্লেষন করে দেখা গেছে প্রায় ৩৫০ টি বিভিন্ন পোকামাকড়, ১৮ টি নিমাটোড, বেশকিছু ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসঘটিত রোগের উপর নিমজাত বালাইনাশক হিসাবে কার্যকর। নিম গাছের পাতা, বাকল বা ছাল ও নিম বীজ হতে নির্যাস পাওয়া যায়। এ নির্যাস বীজ বাহিত মৃত্তিকাবাহিত বিভিন্ন ছত্রাকজনিত রোগ দমনে বিশেষ কার্যকর। যেমন ধানের বাদামী রোগ এবং গোড়াপঁচা রোগ, সবজির গোড়াপঁচা রোগ, ফসলের মরচে রোগ, পাউডারী মিলডিউ এবং ঝিমিয়ে পড়া রোগের ক্ষেত্রেও নিমের নির্যাস অত্যন্ত কার্যকর। বর্ণিত এসকল তথ্য অবগত হয়ে রংপুর কৃষি প্রশিক্ষনায়তনে নিম পাতা ও ছাল থেকে নির্যাস তৈরির একটি প্রণালী সনাক্ত করি। সনাক্তকৃত এই প্রণালীতে নির্যাস তৈরি করে এর যে উপকারিতা পাওয়া যায়, পরবর্তীতে তা চাঁপাইনবাবগঞ্জ উদ্যান উন্নয়ন কেন্দ্রে ব্লক সুপারভাইজারদের (বর্তমানে এসএএও) আইপিএম প্রশিক্ষণ কোর্সে এই প্রণালীতে বালাইনাশক প্রস্তুত এবং প্রয়োগ করে সুফল নিশ্চিতও করা হয়েছিলো। যা ধান উৎপাদন প্রযুক্তি অবলম্বন ও ভবিয্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা বিষয়ক ব্রি-ডিএই যৌথ কর্মশালায় উপস্থাপিত হয়েছিল।
নিমভিত্তিক বালাইনাশক প্রস্তুত প্রণালী অনেকটা এরূপ ঃ
নিম ভিত্তিক নির্যাস প্রস্তুত করতে হলে ৫০০ গ্রাম পাতা এবং পরিত্যাক্ত ডালের ২৫০ গ্রাম ছাল বা বাকল ভালভাবে থেতলে নিতে হবে। তারপর ৫ লিটার পানিতে থেতলানো নিমপাতা ছাল আগুনে গরম করতে হবে। পানি ফুটতে শুরু করলে ৫০ গ্রাম সাধারণ কাপড় কাঁচা সাবান, ১০ গ্রাম তুঁত, ৫ গ্রাম সোহাগা পর্যায়ক্রমে ঐ ফুটান্ত মিশ্রণে মিশাতে হবে। মিশ্রণটি ৪০-৫০ মিনিট ফোটানোর পর ঐ মিশ্রণ ঠান্ডা করে ছেঁকে নিয়ে ৫ (পাঁচ) গুন পানির সঙ্গে মিশিয়ে একটি মিশ্রণ তৈরি করতে হবে। এ বালাইনাশকটি পাতার যে কোন পোকা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা দমনে বিশেষ ফলদায়ক। নিম পাতা বীজ সংরক্ষণেও ব্যবহৃত হয় যা বীজকে পোকামাকড়মুক্ত রাখে এবং সংরক্ষিত বীজের অক্সিজেন নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বীজের স্থায়ীত্ব বৃদ্ধি করে।
জৈব বালাইনাশক হিসেবে নিমের নির্যাস রাসায়নিক কীটনাশকের চেয়ে সস্তা, কার্যকর এবং পরিবেশ বান্ধব বিধায় রোগবালাই দমনে নিমের পাতা ও নির্যাস ব্যবহার ডিএইর উন্নয়ন কর্মসূচী মাধ্যমে চালু রাখা দরকার। এর সাথে সাথে দেশী নিমের চাষ বৃদ্ধির প্রচেষ্টাও অব্যহত রাখতে হবে। এরই মধ্যে ভারত, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ায়, ইন্দোনেশিয়া সহ নানা দেশে জৈব বালাইনাশক হিসেবে নিমের ব্যাপক ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদেরও মাঠ পর্যায়ে লো-কষ্ট/ নো-কষ্ট প্রযুক্তি হিসেবে এর ব্যবহার সম্প্রসারণ করা এখনও সময়ের দাবি।
লেখক: **সাবেক মহা পরিচালক, ডিএই। *বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটএ ১৩-১৬ ফেব্রুয়ারী ১৯৯৯ অনুষ্ঠিত ধান উৎপাদন প্রযুক্তি অবলম্বন ও ভবিয্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা বিষয়ক ব্রি-ডিএই যৌথ কর্মশালায় উপস্থাপিত।