ড. মো. দেলোয়ার হোসেন মজুমদার
ডিম উচ্চ পুষ্টিমান সমৃদ্ধ খাবার যা সহজে পরিপাক যোগ্য। আজকের দিনে উচ্চ বিত্তের খাবার টেবিলে কিংবা নি¤œ আয়ের স্কুল পড়ুয়া বালিকার টিফিন বক্সে ডিমের উপস্থিতি থাকে প্রায় প্রতিদিন। ডিম আসলে একটি প্রজনন কোষ যা থেকে ভ্রণ তৈরি হবে, সৃষ্টি হবে পরবর্তী প্রজন্ম – এটাই প্রজনন কোষ যা থেকে ভ্রণ তৈরী হবে, সৃষ্টি হবে পরবর্তী প্রজন্ম – এটাই প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম। প্রকৃতি হয়তো জানতোনা এই ডিমই একদিন মানুষ তার খাদ্য তালিকার অন্যতম উপাদান হিসাবে গ্রহণ করবে।
স্বাস্থ্য সচেতন লোকেরা ডিম খাওয়ার ব্যাপারে সব সময়ই একটা অনুমান নির্ভর দুশ্চিন্তায় ভুগেন। তাদের এই দুশ্চিন্তার কারণ ডিমের কোলেস্টেরল। কলেস্টেরল হৃদরোগও মস্তিকে রক্ত ক্ষরণের জন্য দায়ী। তবে এসব ক্ষেত্রে ডিম কতটুকু দায়ী? ডিমের উপাদান সম্পর্কে ধারণা থাকলে দুচিন্তার আর কোন কারণ থাকবেনা। পরীক্ষা করে দেখা গেছে, একটি ডিমে সাদা অংশ বা অ্যালবুমিন থাকে ৩৪-৩৫ গ্রাম যা ডিমের মোট ওজনের শতকরা প্রায় ৫৭ ভাগ, কুসুম থাকে ১৪-১৯ গ্রাম বা ৩১ ভাগ আর খোসা থাকে ৫-৭ গ্রাম বা ১২ ভাগ।
ডিমে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, চর্বি, ভিটামিন এবং খনিজ সমৃদ্ধ খাদ্য উপাদান। ২০ প্রকার অ্যমাইনো অ্যাসিডের মধ্যে ৮ প্রকার অ্যমাইনো অ্যাসিড মানব দেহের জন্য অত্যাবশ্যকীয়। আর ডিমে এই ৮টি অত্যাবশ্যকীয় অ্যমাইনো অ্যাসিডের সব গুলোই বিদ্যমান। ডিমে যে অ্যামাইনো অ্যাসিডগুলো থাকে সেগুলো হলো- গ্লুটামিক অ্যাসিড-১.৬ গ্রাম, এসপারটিক অ্যাসিড-১-৩ গ্রাম. ডলউসিন -১.১ গ্রাম. সেরিন-০.৯ গ্রাম, লাইসিন-০.৯ গ্রাম, ভেলিন-০.৮ গ্রাম, এনালাইন-০.৭ গ্রাম, আইসোলিউসিন -০.৭ গ্রাম, ফিনাইল এলানাইন -০.৬৫ গ্রাম, থ্রিওনাইন-০.৬ গ্রাম, টাইরোসিন-০.৫ গ্রাম, প্রোলিন-০.৫ গ্রাম, গ্লাইসিন -০.৪ গ্রাম, মিথিওনাইন-০.৪ গ্রাম, হিসটিউন-০.৩ গ্রাম, সিসটিন-০.৩ গ্রাম, ট্রিপটোফেন-০.১৫ গ্রাম।
ডিমে আছে প্রচুর পরিমাণে ফ্যাটি অ্যসিড। ৬০ গ্রাম ওজনের একটি ডিমে ঝধঃঁৎধঃবফ বা সম্পৃক্ত চর্বির পরিমাণ ১.৮৬ গ্রাম, টহংধঃঁৎধঃবফ বা অসম্পৃক্ত চর্বির পরিমাণ ৩.১২ গ্রাম এবং কোলেস্টেরলের পরিমাণ ২২৫ মিলিগ্রাম। চর্বি জাতীয় খাদ্যের গুণাগুন বিচারের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ঝধঃঁৎধঃবফ বা সম্পৃক্ত চর্বি এবং টহংধঃঁৎধঃবফ বা অসম্পৃক্ত চর্বির অনুপাত। উচ্চ মাত্রার কোলেস্টেরলের সাথে সম্পৃক্ত চর্বি খাদ্যে মিলিত হলে মানুষের জন্যে হৃদরোগের কারণ হতে পারে এটা সত্য। কিন্তু ডিমে ঝধঃঁৎধঃবফ বা সম্পৃক্ত চর্বির চেয়ে মানবদেহের জন্য উপকারী টহংধঃঁৎধঃবফ বা অসম্পৃক্ত চর্বির পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ। ডিমের মধ্যস্থিত ফ্যাটি অ্যসিডের ৪৭-৪৮ ভাগ মনো টহংধঃঁৎধঃবফ ১৮ ভাগ পলি আর মাত্র ৩৪ ভাগ হলো ঝধঃঁৎধঃবফ।
কলেস্টেরল অপরিহার্য
শরীরের বিপাকীয় কাজে কলেস্টেরেল সব সময় এক গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মানবদেহে পুরুষদের সেক্স হরমোন, টেস্টোস্টেরন আর মহিলাদের সেক্স হরমোন, ইস্ট্রোজেন উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন কোলেস্টেরল। ভিটামিন-ডি এবং যকৃতের বাইল অ্যসিডের প্রাথমিক উৎস কলেস্টেরল। মানবদেহে কোলেস্টেরলের মাত্রার চেয়ে ঐউখ বা হাই ডেনসিটি লাইপো প্রোটিন এবং খউখ বা লো ডেনসিটি লাইপো প্রোটিন এর অনুপাতই সবচেয়ে বেশী গুরত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ এর মাধ্যমে কোলেস্টেরল রক্তনালী দিয়ে কোষে প্রবেশ করে। রক্ত থেকে যখন খউখ বের হতে না পারে তখনই রক্তনালীতে জমাট বাধতে থাকে। কিন্তু ঐউখ কোলেস্টেরলকে বহন করে কোষে পৌছে দিয়ে যকৃতে জমা হয়। হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক গবেষণায় দেখেছেন যে, একজন সুস্থ ব্যক্তি প্রতিদিন একটি ডিম খেলে তার রক্তে কলেস্টেরলের মাত্রা কখনই বিপদজনক মাত্রায় পৌঁছায় না।
ডিমে এমন কিছু উপাদান আছে যেমন এইচডিএল, অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড ওমেগা- ৩, যা রক্তের কলেস্টেরলের পরিমাণ হ্রাস করে এবং রক্তনালীতে এলডিএল বা লো ডেনসিটি লাইপো প্রোটিন জমতে বাধা দেয়। ফলে হৃদরোগ এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি বহুলাংশে কমে যায়। ডিমে বিদ্যমান খনিজ পর্দাথগুলো হলো আয়োডিন যা থাইরয়েড হরমোন তৈরীতে কাজে লাগে, ফসফরাস যা হাড় গঠনের জন্য প্রয়োজন। এছাড়াও আছে সোডিয়াম ০.১২ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ০.০৫ গ্রাম, কোরিন ০.১৮ গ্রাম, পটাশিয়াম ০.১২ গ্রাম। ডিমের ট্রেস এলিমেন্ট (ঞৎধপব বষবসবহঃ) গুলো হলো ফেরাস যা লোহিত রক্তকণিকা তৈরীতে কাজে লাগে, জিংক ক্ষত সারাতে এবং ইনফেকসানের বিরুদ্ধে কাজ করে, এছাড়াও যে ট্রেস এলিমেন্টগুলো বিদ্যমান তা হলো ম্যাঙ্গানিজ, ম্যালবডি নাম এবং কপার (গহ, গড়, ঈঁ)।
ভিটামিন
মানব দেহের জন্য ভিটামিন অত্যাবশকীয় একটি উপাদান আর ডিমে রয়েছে অনেক ধরণের ভিটামিন। এগুলো হলো প্যানটোথেনিক অ্যাসিড ১.৩ সম, রিবোফাবিন ০.৫ সপম, ইউ ০.১৪ সপম, নিয়াসিন ০.০৭ সপম, থায়ামিন ০.০৬ সম, ভিটামিন ই ২-৩১০ সপম, ভিটা অ -৭৪০ সপম, ফলাসিন -৪৬ সপম, ভিটা ই ১২- ১.০ সপম মানুষের জন্য অত্যন্ত উপকারী ঙসবমধ -৩ ডিমে প্রচুর পরিমাণে বিদ্যমান। এই ফ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড শরীরের সাইকোটাইনিস নিয়ন্ত্রণকরে। ফলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে এ ঙসবমধ -৩ রক্তের প্লাজমায় ট্রাইগ্লিসারিডের পরিমাণ কমায়, যার ফলে হৃদরোগের ঝুঁকি কমে যায়। ঙসবমধ-৩ চোখের দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখে। জাপানী ডা: কামিয়াকির মতে ডিম ঙসবমধ-৩ এর পাশাপাশি অন্তঃত ২০০ ধরণের অ্যান্টিবডি রয়েছে, যা মানব দেহে সালমোনেলা আক্রমণ রোধকরে। রক্তের জমাট বাধা বা থ্রম্বোসিসের মাত্রা কমিয়ে নিতে পারে এই ঙসবমধ-৩। মাংসের ক্ষয়পূরণ রোধকল্পে ও ব্রেষ্ট ক্যান্সার রোধেও ঙসবমধ-৩ কাজ করে থাকে। ডিমে আছে কলিন, যা ¯œায়ুতন্ত্রের স্বাভাবিকতা বজায় রাখতে ভূমিকা রাখে। মস্তিস্ক এবং কাডিও-ভাসকুলারসিস্টেমের জন্যও উপকারী কলিন। যকৃতের কাজ স্বাভাবিক রাখতে কলিন কাজ করে। স্তন ক্যন্সার রোধেও এ কলিন কাজ করে। কলিন বাচ্চাদের নিউরন কোষ তৈরিতে সহায়তা করে, যা মেমোরী সেন্টার (গবসড়ৎু পবহঃৎব) গঠনে ভূমিকা রাখে। গর্ভবতী মাকে প্রতিদিন একটি করে ডিম খাওয়ালে বাচ্চা হতে পারে উন্নত স্মৃতি শক্তির অধিকারী।
কলিন রক্ত নালীতে পযড়ষবং:বৎড়ষ এর জমাট বাঁধতে বাধা দেয়। কারণ হোমসিসটিন নামক অ্যমাইনো অ্যসিড যা রক্ত জমাট বাধতে সাহায্য করে। সেই হোমসিসটিনকে ভেঁঙ্গে ফেলে এই কলিন। চুলের সুস্থতা বজায় রাখতে ডিমের মধ্যে যে সালফার, ভিটামিন ও মিনারেল আছে এদের ভূমিকা অনেক বেশী। ডিমের ক্যারোটিনয়েড পিগমেন্ট ভিটামিন-এ এর উৎস এবং এটি অ্যান্টি- অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। ক্যরোটিনয়েড পিগমেন্ট ক্যান্সারের বিরুদ্ধে কাজকরে থাকে। ডিমের জৈব ক্রোমিয়াম, ইনসুলিন উৎপাদনের মাধ্যমে রক্তে চিনির সক্ষমতা বজায় রাখে এবং ডিমের মধ্যে যে এলবুমিন আছে তা মিউকাস মেমব্রেনকে রক্ষণাবেক্ষণ করে ফলে পাকস্থলীর প্রদাহ, আলসার, ডায়রিয়া, ইত্যাদি প্রতিরোধ বিশেষ ভূমিকা রাখে।
ডিম নিয়ে আছে অনেক কুসংস্কার। ডিমের পুষ্টিগুণ নিয়ে আছে অস্বচ্ছতা। পরীক্ষার দিন ডিম খাওয়া যাবেনা, বয়স্ক মানুষের ডিম খাওয়া যাবেনা, ডিম খেলে হৃদরোগের আশংকা বেড়ে যায় ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ডিম একটি আর্দশ খাদ্য, ডিমে আছে বহুগুণ। তাই আসুন শিশু, বৃদ্ধ, নারী, পুরুষ সকলেই প্রতিদিন একটি করে ডিম খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলি। এতে আপনি পুষ্টি পাবেন সহজে, আপনার জীবনী শক্তি বেড়ে যাবে অনেকাংশে। পাশাপাশি পোল্ট্রি শিল্পের বিকাশ হবে আর উন্নয়ন হবে এদেশের হাজার হাজার ছোট বড় খামারীর। যারা রোদে পুড়ে, বৃষ্টি জলে ভিজে উৎপন্ন করেছে আমার ও আপনার পুষ্টি । (সংকলিত)
————————————
লেখক: কৃষি গবেষক ও পুষ্টিবিদ, উপ পরিচালক, নাটা, গাজীপুর।