মোঃ মোতাহার হোসেন ও ড. কে, এম, খালেকুজ্জামান
মরিচ বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ আয়বৃদ্ধিকারক মসলা জাতীয় ফসল। ইহা বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্র চাষ হয়ে থাকে। প্রতিদিনের রান্নায় ইহা আমরা ব্যবহার করে থাকি। বাংলাদেশে মরিচের উৎপাদন কম হওয়ার অনেক কারণ রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে পোকামাকড়ের আক্রমণ। এসব পোকা মাকড়ের মধ্যে রয়েছে চুষি পোকা, লাল মাকড়, সাদা মাছি, জাব পোকা এবং ফলছিদ্রকারী পোকা। এসব পোকামাকড়ের মধ্যে শুধুমাত্র চুষি পোকা ও মাকড়ের আক্রমণের কারণে মরিচের ফলন পরিমাণগতভাবে প্রায় ৭৫-৮০ % হ্রাস পায়। মরিচের পোকামাকড় দমন করতে পারলে মরিচের উৎপাদন অনেক গুণ বেড়ে যাবে, তাই নিম্নে মরিচের কিছু পোকা-মাকড় ও তাদের দমন ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করা হল।
১. কাটুই পোকা
আক্রান্ত হওয়ার পর্যায়- জমিতে চারা রোপণের পর পরই এই পোকা রাতের বেলা গাছের গোড়া কেটে দিয়ে ব্যপক তি সাধন করে থাকে।
ক্ষতির ধরণ- কচি চারা গাছ গোড়া কাটা অবস্থায় মাটিতে পড়ে থাকে। শুককীট দিনের বেলায় গাছের গোড়ায় মাটির সামান্য নিচে বা আবর্জনার ভিতর বিশ্রাম নেয় এবং রাতে উপরে উঠে চারা গাছের গোড়া কেটে দেয়। শুককীট যা খায় তার চেয়ে অনেক বেশী চারা বা গাছের গোড়া কেটে নষ্ট করে।
দমন ব্যবস্থা-
বিষটোপ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ১০০ গ্রাম গমের ভূষি আথবা ধানের কুড়া, ১০০ গ্রাম চিটা গুড় এবং ২০০ গ্রাম সেভিন ৫০ ডব্লিউ পি সবগুলো একত্রে মিশিয়ে প্রয়োজনীয় পানি দিয়ে মন্ড তৈরী করতে হবে। সন্ধ্যার পর মন্ড ছিটিয়ে দিলে শুককীট আকর্ষিত হবে এবং এই বিষটোপ খেয়ে মারা যাবে।
১ মিলিলিটার পরিমাণ সুমিসাইডিন ২০ ইসি বা রিপকর্ড ১০ ইসি বা সিমবুশ ১০ ইসি ১ লিটার পরিমাণ পানির সাথে মিশিয়ে সন্ধ্যার সময় জমিতে ছিটিয়ে দিলে এই পোকা নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
জমি তৈরীর সময় দানাদার জাতীয় ঔষধ শতকে ৪০ গ্রাম হারে প্রয়োগ করতে হয়। অনেক সময় ফাড সেচ দিলে মাটির গর্ত থেকে কাটুই পোকা বের হয়ে আসে ফলে পাখিতে খেয়ে ফেলে।
২. থ্রিপস
আক্রান্ত হওয়ার পর্যায়- সাধারণতঃ কচি চারা গাছ ও চারা রোপণের ৭-১৭ দিনের মধ্যে এই পোকা মরিচ গাছকে আক্রমণ করে।
ক্ষতির ধরণ- থ্রিপস কচি পাতার রস শুষে খায় ফলে পাতা উপরের দিকে কুঁকড়ে যায়। পাতার মধ্যশিরার নিকটবতী এলাকা বাদামী রঙ ধারণ করে ও শুকিয়ে যায় নতুন কিংবা পুরাতন পাতার নিচের পিঠে অধিক ক্ষতি হয় নৌকার খোলের ন্যায় পাতা উপরের দিকে কুঁকড়ে যায় আক্রান্ত পাতা বিকৃত ও বেঢপ দেখায়
দমন ব্যবস্থা-
আঠালো সাদা ফাঁদ (প্রতি হেক্টরে ৪০ টি) ব্যবহার করে পোকা নিয়ন্ত্রণ করা।
এক কেজি আধা ভাঙ্গা নিম বীজ ২০ লিটার পানিতে ২৪ ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে উক্ত পানি (ছেঁকে নেওয়ার পর) পাতার উপরের দিকে স্প্রে করা।
আন্তঃ ফসল হিসাবে মরিচের সঙ্গে গাজর (রেপিলেন্ট ক্রপ) চাষ করে।
আক্রমণ বেশি হলে ফিপ্রোনিল (রিজেন্ট/এসেন্ড/গুলি/অন্য নামের) বা ডাইমেথয়েট (বিস্টারথোয়েট/টাফগর/অন্য নামে) ১০ লিটার পানিতে ১০ মিলি হারে বা সাকসেস ১০ লিটার পানিতে ১২ মিলি হারে ¯েপ্র করে এদের নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
চারা রোপণের ১০-৩০ দিনের মধ্যে তিন বার ১০ দিন অন্তর অন্তর এই পোকা দমনের জন্য প্রতি ১০ লিটার পারিতে ৫ মিলি এ্যাডমায়ার/টিডো/গেইন ঔষধ প্রতি ৫ শতক জমিতে স্প্রে করতে হয়।
৩. এফিড বা জাব পোকা
আক্রান্ত হওয়ার পর্যায়- মরিচ গাছের কচিও বয়স্ক পাতা
ক্ষতির ধরণ- সব ধরণের পাতার নীচের দিকে বসে রস শুষে খায় এমনকি এরা গাছের কান্ডেও আক্রমণ করে থাকে ফলে কান্ড শুকিয়ে মারা যায়।
দমন ব্যবস্থা-
আঠালো হলুদ ফাঁদ (প্রতি হেক্টরে ৪০ টি) ব্যবহার করে।
আধা ভাঙ্গা নিম বীজের (৫০ গ্রাম এক লিটার পানিতে ২৪ ঘন্টা ভেজানোর পর মিশ্রণটি ছাঁকতে হবে) নির্যাস আক্রান্ত গাছে ১০ দিন পর পর ৩ বার ¯েপ্র করে এই পোকা নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
বন্ধু পোকাসমূহ (লেডীবার্ড বিটলের পূর্নাঙ্গ ও কীড়া এবং সিরফিড ফাই) প্রকৃতিতে লালন।
আক্রমণ বেশি হলে স্বল্পমেয়াদী বিষক্রিয়ার ম্যালাথিয়ন ৫৭ ইসি (ফাইফানন/ সাইফানন/ অন্য নামের) ১০ মিলি অথবা কুইনালফস ২৫ ইসি (করলাক্স/ একালাক্স/ কিনালাক্স/ অন্য নামের) বা ডাইমেথয়েট (বিস্টারথোয়েট/টাফগর/অন্য নামে) বা কেরাতে ১০ লিটার পানিতে ১০ মিলি হারে বা সাকসেস ১০ লিটার পানিতে ১২ মিলি হারে স্প্রে করে এদের নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
৪. সাদা মাছি
আক্রান্ত হওয়ার পর্যায়- সাধারণতঃ কচি চারা গাছ আক্রমণ করে।
ক্ষতির ধরণ- কচি পাতার নিচে বসে রস শুষে খায় ফলে পাতা কুঁকড়ে যায়।
দমন ব্যবস্থা-
সাবান-পানি ব্যবহার (প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম ডিটারজেন্ট ) করে।
নিম বীজের নির্যাস (আধা ভাঙ্গা ৫০ গ্রাম নিম বীজ ১ লিটার পানিতে ২৪ ঘন্টা ভিজিয়ে মিশ্রণটি ছেঁকে নিয়ে) ¯েপ্র করা ।
আক্রমণ বেশি হলে ম্যালাথিয়ন ৫৭ইসি (১০ লিটার পানিতে ১০ মিলি হারে) অথবা এডমায়ার ২০০ এসএল (১০ লিটার পানিতে ৫ মিলি হারে) স্প্রে করে।
৫. ফল ছিদ্রকারী পোকা
আক্রান্ত হওয়ার পর্যায়- এই পোকা কচি ও বাড়ন্ত ফল ছেদ করে ভিতরে ঢুকে ফলের ভিতরের অংশ খেয়ে ফেলে।
ক্ষতির ধরণ- ফলের বৃন্তের কাছে একটি ক্ষুদ্র আংশিক বদ্ধ কালচে ছিদ্র দেখা যাবে। ক্ষতিগ্রস্ত ফলের ভিতরে পোকার বিষ্ঠা ও পচন দেখা যাবে। পোকা আক্রান্ত ফল নিধারিত সময়ের পূর্বেই পাকে বা ঝড়ে পড়ে।
দমন ব্যবস্থা-
সেক্স ফেরোমন ফাঁদ (প্রতি বিঘায় ১৫টি) ব্যবহার করে পোকা নিয়ন্ত্রণ করা ।
ডিম নষ্টকারী পরজীবী পোকা, ট্রাইকোগ্রামা কাইলোনিজ ও কীড়া নষ্টকারী পরজীবী পোকা, ব্রাকন হেবিটর পর্যায় ক্রমিকভাবে মুক্তায়িত করে এদের নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
আধভাঙ্গা নিম বীজ (৫০ গ্রাম এক লিটার পানিতে ২৪ ঘন্টা ভিজানোর পর মিশ্রণটি ছাকতে হবে) নির্যাস আক্রান্ত গাছে ১০ দিন পর পার ৩ বার স্প্রে করে এই পোকা অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
আক্রমণ তীব্র হলে কুইনালফস ২৫ ইসি (দেবীকুইন/কিনালাক্স/করলাক্স) প্রতি ১০ লিটার পানিতে ১০ মিলি হারে মিশিয়ে স্প্রে করা যেতে পারে বা সাকসেস ১০ লিটার পানিতে ১২ মিলি হারে স্প্রে করে এদের নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
বেশি মরিচ এ পোকা দ্বারা আক্রান্ত হলে ডেনিটল ১০ ইসি/ ট্রিবন ১০ ইসি / রিপকর্ড ১০ ইসি প্রতি লিটার পানিতে ১ মি.লি. হারে অথবা ফেনকিল ২০ ইসি প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি. হারে অথবা সুমিথিয়ন ৫০ ইসি ২ মি.লি. হারে এগুলোর যে কোন একটি কীটনাশক প্রতি লিটার পানির সাথে মিশিয়ে গাছের সমস্ত অংশ ভালভাবে মিশিয়ে স্প্রে করা।
৬. মাকড় বা মাইট
আক্রান্ত হওয়ার পর্যায়- মাইট মরিচ গাছের কচি ও বয়স্ক পাতা আক্রমণ করে।
ক্ষতির ধরণ- সাধারণত পাতার নীচের দিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শিরার মধ্যকার এলাকা বাদামী রং ধারণ করে ও শুকিয়ে যায় এবং মারা ভাবে আক্রান্ত পাতা সহজেই ভেঙে গুঁড়িয়ে যায়। কচি পাতা মাকড় দ্বারা আক্রান্ত হলে পাতা নীচের দিকে মুড়ে গিয়ে স্বাভাবিকের চেয়ে সরু হয়ে যায় ।
দমন ব্যবস্থা-
নিমতেল ৫ মিলি + ৫ গ্রাম ট্রিকস প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে পাতার নীচের দিকে ¯েপ্র করতে হবে ।
এক কেজি আধা ভাঙ্গা নিম বীজ ২০ লিটার পানিতে ২৪ ঘন্টা ভিজিয়ে রেখে উক্ত পানি (ছেকে নেওয়ার পর) পাতার নীচের দিকে ¯েপ্র করা।
পাইরিথ্রয়েড জাতীয় কীটনাশক ব্যবহার যথাসম্ভব পরিহার করতে হবে।
আক্রমণ বেশি হলে মাকড়নাশক ওমাইট ৫৭ইসি (প্রতি লিটার পানিতে ২.০ মিলি হারে) বা ভার্টিমেক ১.৮ ইসি প্রতি ১০ লিটার পানিতে ১২ মিলি হারে পাতা ভিজিয়ে ¯েপ্র করে মাকড়ের আক্রমণ প্রতিহত করা সম্ভব।
মাকড়ের সাথে অন্য পোকার আক্রমণ দেখা দিলে প্রথমে মাকড়নাশক ব্যবহার করে অতপর কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে।
লেখকঃ
মসলা গবেষণা কেন্দ্র, শিবগঞ্জ, বগুড়া।