কৃষিবিদ মোঃ সিরাজুল ইসলাম
কোয়েল পোলট্রির (Poultry) একটি ক্ষুদ্র প্রজাতি। বর্তমানে বাংলাদেশে লাভজনকভাবে খামারে হাঁস-মুরগির মতো কোয়েলও পালন করা হচ্ছে। কোয়েলের মূল উৎস অনিবিড় বা হাল্কা জঙ্গল। জাপানি কোয়েল বাংলাদেশে পোষা পাখির মতো পালন করা হচ্ছে। প্রজাতিগত ও খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমে কোয়েল এখন লোকালয়ে প্রতিপালিত হচ্ছে। বলতে গেলে হাঁস-মুরগির চেয়েও ঘনিষ্ঠভাবে বাণিজ্যিক ও পারিবারিক পদ্ধতিতে কোয়েল চাষাবাদ হচ্ছে।
বাংলাদেশে পাখি পালনে কোয়েল একটি অনন্য সংযোজন। এ দেশের আবহাওয়া কোয়েল পালনের জন্যে বেশ উপযোগী। আমাদের পুষ্টি চাহিদা মেটাতে কোয়েল পালন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। বাংলাদেশে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কোয়েল পালনের সম্ভাবনা খুবই উজ্জ্বল।
কোয়েল পালনের গুরুত্ব ঃ একটি মুরগি পালনের জায়গায় ১০টি কোয়েল পালন করা যায়। তাই অল্প জায়গায় অনেক কোয়েল পালন করা যায়। প্রারম্ভিক খরচ কম হওয়ায় অল্প পূঁজিতে এ ব্যবসা শুরু করা যায়। কোয়েলের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি। কোয়েলের খাদ্যচাহিদা কম অথচ খুব দ্রুত বাড়ে। এদের খাদ্য রূপান্তরের ক্ষমতা (এফ সি আর) ভালো (৩ঃ১)। অর্থাৎ এরা ৩ কেজি খাদ্য খেয়ে ১ কেজি উৎপাদন দেয়। মাত্র ৬-৭ সপ্তাহে এরা ডিম দেয়। বছরে একটি কোয়েল ২৯০-৩০০টি ডিম দিয়ে থাকে। ১৭-১৮ দিনে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। কোয়েলের মাংস বেশ সুস্বাদু ও দেহের ৭২% মাংস হিসেবে খাওয়া যায়। এরা সাধারণত কুঁচে বসে না।
কোয়েলের জাত ও বৈশিষ্ট্য ঃ বর্তমান বিশ্বে কোয়েলের ১৮টি প্রজাতি রয়েছে। জাত ও উপজাত ভেদে এদের গায়ের রং, ওজন, আকার, আকৃতি, ডিম পাড়ার হার, ডিমের ওজন, বেঁচে থাকার হার ইত্যাদি বিভিন্ন হয়ে থাকে। উৎপাদনের ভিত্তিতে কোয়েলের জাতকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়। যথা ঃ ক) লেয়ার কোয়েল (Layer Quail) ডিম উৎপাদনকারী জাত ও খ) ব্রয়লার কোয়েল (Broiler Quail) মাংস উৎপাদনকারী জাত।
ক. লেয়ার কোয়েল (Layer Quail) ডিম উৎপাদনকারী জাত ঃ বর্তমানে যেসব প্রজাতির ডিম উৎপাদনকারী কোয়েল বেশি জনপ্রিয় সেগুলো হলো- ফারাও, ব্রিটিশ রেঞ্জ, ইংলিস হোয়াইট, ব্রাউন, টক্সেডো।
খ. ব্রয়লার কোয়েল(Broiler Quail) মাংসা উৎপাদনকারী জাত ঃ ব্রয়লার কোয়েলের মাংস নরম ও সুস্বাদু। এগুলো উঁচুমানের পুষ্টিকর খাদ্য হিসেবে বিবেচিত। পাঁচ সপ্তাহ বয়সের একেকটি ব্রয়লার কোয়েলের ওজন ১৫০ গ্রাম পর্যন্ত হয়। মাংস উৎপাদনের জন্য যেসব কোয়েল সুপরিচিতি সেগুলো হলো- বব হোয়াইট (আমেরিকান), হোয়াইট ব্রেস্টেড (ইন্ডিয়ান), ম্যানচুরিয়াল গোল্ডেন।
কোয়েলের জীবন চক্র (Life Cycle of Quail) ঃ কোয়েল সাধারণতঃ ৩-৪ বছর বেঁচে থাকে। একটি পূর্ণ বয়স্ক কোয়েলের ওজন ১৫০-২০০ গ্রাম হয়। এরা ৬-৭ সপ্তাহ বয়সেই ডিম দেয়া আরম্ভ করে। ডিমের ওজন ৮-১২ গ্রাম হয়ে থাকে। বছরে এরা ২৯০-৩০০টি ডিম দিয়ে থাকে। বিকেল ৩ থেকে ৬টার মধ্যে ৭৫% পাখি ডিম পাড়ে। সন্ধ্যা ৬ থেকে রাত ১টার মধ্যে অবশিষ্ট ২৫% পাখি ডিম পাড়া সম্পন্ন করে। কোয়েলের ডিম দেখতে বেশ সুন্দর কারুকাজ খচিত। ডিমের খোসার উপর নীল, বেগুনি, কাল, খয়েরি রঙের ফোঁটা দাগ থাকে। কোয়েলের বাচ্চা ফুটতে ১৭ দিন সময় লাগে। সদ্য ফোটা বাচ্চার গড় ওজন ৬-৭ গ্রাম হয়। কোয়েল কখনও কুঁচে বসে না। ডিম থেকে বাচ্চা ফোটাতে হলে ৩টি স্ত্রী কোয়েলের সাথে ১টি পুরুষ কোয়েল রাখতে হবে। কুঁচে মুরগির নিচে দিয়ে অথবা ইনকিউবেটর যন্ত্রের সাহায্যে কোয়েলের ডিম ফুটানো যায়। উল্লেখ্য যে, কোয়েলের বাচ্চা খুব পরিবেশ সংবেদনশীল হয়। জন্মের সময় বাচ্চার গায়ে পালক থাকে না। বাচ্চা শক্ত হতে ২ সপ্তাহ সময় লাগে। সম্পূর্ণ পালক গজাতে ৪ সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লাগে।
কোয়েলের বাচ্চা পালন ঃ কোয়েলের বাচ্চার জন্য ১৪ দিন বা অবস্থাভেদে ২১ দিন পর্যন্ত কৃত্রিম তাপ দিয়ে ব্রুডিং (ইৎড়ড়ফরহম) করতে হয়। সদ্য ফোটা কোয়েল বাচ্চাদের জন্য ব্রুডিং এর ব্যবস্থা করতে হবে। এরা এ সময় তাপের প্রতি খুব স্পর্শকাতর থাকে। খাঁচা বা লিটার উভয় পদ্ধতিতেই কোয়েলের বাচ্চা পালন করা যায়। তবে সঠিক ভাবে বাচ্চা পালনের জন্য যে সব বিষয়ের প্রতি বিশেষ যতœবান হতে হবে তা হচ্ছে- ১. সঠিক তাপমাত্রা বজায় রাখা, ২. পর্যাপ্ত আলো ও বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখা, ৩. বাচ্চার ঘনত্ব বেশি না হওয়া, ৪. পর্যাপ্ত খাদ্য ও পানি সরবরাহ করা ও ৫. স্বাস্থ্য বিধি পালন করা।
কোয়েলের আবাস ঃ লিটার এবং খাঁচায় উভয় পদ্ধতিতেই কোয়েল পালন করা যায়। তবে খাঁচায় পালন করা অধিক সুবিধাজনক। ১২০ সে.মি দৈর্ঘ্য, ৬০ সে.মি প্রস্থ এবং ২৫ সে.মি উচ্চতা বিশিষ্ট একটি খাঁচায় ৫০টি কোয়েল পালন করা যায়। ইদানিং কোয়েল পালনের জন্য সুবিধাজনক প্লাষ্টিকের খাঁচা পাওয়া যাচ্ছে। ৩ সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত বাচ্চার খাঁচার মেঝের জালের ফাঁক হবে ৩ মি.মি X ৩ মি.মি এবং বাড়ন্ত ও পূর্ণবয়স্ক কোয়েলের খাঁচার মেঝের জালের ফাঁক হবে ৫ মি.মি X ৫ মি.মি। মুরগির খামারে ব্যবহৃত পাত্রাদির চেয়ে আকারে ছোট পাত্র কোয়েলের জন্য ব্যবহার করলে ভালো হয়। তবে কোয়েল খুব ঘন ঘন পানি পান করে। তাই কোয়েলের খাঁচার কয়েকটি স্থানে পানির ব্যবস্থা রাখতে হবে এবং লক্ষ্য রাখত হবে পানির পাত্রগুলো যেন খাঁচার সাথে শক্ত করে আটকানো থাকে, যাতে পানির পাত্র উপচে বা উল্টে পড়ে কোয়েলের গা ভিজে না যায়। কোয়েলের ঘরে পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের ব্যবস্থা রাখতে হবে। বিষ্ঠা অবসারনের জন্য ট্রে ব্যবহার করতে হবে। কোয়েলের আবাস রাস্তার কাছে, কোলাহল ও শিকারী প্রাণীর নাগালের বাইরে হতে হবে।
কোয়েলের খাদ্য ঃ ডিম এবং মাংস উৎপাদনের জন্য কোয়েলকে সুষম খাদ্য দিতে হবে। অর্থাৎ সরবরাহকৃত খাদ্যে সবগুলো খাদ্য উপাদানই যথেষ্ট পরিমাণে বিদ্যমান থাকতে হবে। পূর্ণবয়স্ক কোয়েলের খাদ্যে ২২% আমিষ এবং প্রতি কেজি খাদ্যে ২৭০০ কিলো ক্যালরি শক্তি থাকা আবশ্যক। একটি পূর্ণবয়স্ক কোয়েল প্রতিদিন ২০-২৫ গ্রাম খাদ্য খেয়ে থাকে। কোয়েলের সুষম খাদ্যের একটি তালিকা দেখানো হলো।
ছক-১ ঃ কোয়েলের সুষম খাদ্য তালিকা
উপকরণ |
বয়স ভেদে খাদ্যের পরিমাণ (গ্রাম) |
||
০-৩ সপ্তাহ পর্যন্ত |
৪-৫ সপ্তাহ পর্যন্ত |
৫ সপ্তাহ পর বা পূর্ণবয়স্ক |
|
গম ভাঙ্গা |
৫০০ গ্রাম |
৫৩০ গ্রাম |
৫৩০ গ্রাম |
চালের মিহি কুঁড়া |
৭০ গ্রাম |
৯০ গ্রাম |
৯০ গ্রাম |
তিলের খৈল |
১৫০ গ্রাম |
১৫০ গ্রাম |
১৫০ গ্রাম |
শুটকি মাছের গুঁড়া |
২৪০ গ্রাম |
১৮০ গ্রাম |
১৮০ গ্রাম |
ঝিনুক চূর্ণ |
২৫ গ্রাম |
৩৫ গ্রাম |
৩৫ গ্রাম |
লবণ |
২.৫০ গ্রাম |
২.৫০ গ্রাম |
২.৫০ গ্রাম |
খণিজ মিশ্রণ ও সয়াবিন তেল |
১২.৫০ গ্রাম |
১২.৫০ গ্রাম |
১২.৫০ গ্রাম |
সর্বমোট = |
১০০০ গ্রাম |
১০০০ গ্রাম |
১০০০ গ্রাম |
ছক-২ ঃ বাচ্চা ও পূর্ণবয়স্ক কোয়েলের পুষ্টি, খাদ্য ও পানির প্রয়োজনের তালিকা
বয়স ভিত্তিক পুষ্টি, খাদ্য, পানি ও প্রয়োজনীয় স্থান |
বয়স |
||
০-৩ সপ্তাহ পর্যন্ত |
৪-৫ সপ্তাহ পর্যন্ত |
৫ সপ্তাহ পর বা পূর্ণবয়স্ক |
|
আমিষ |
27% |
24% |
22% |
প্রতিটি পাখির জন্য দৈনিক খাদ্যের প্রয়োজন (গ্রাম) |
৩-১২ |
১৩-১৯ |
২০-২৫ |
প্রতিটি পাখির জন্য খাদ্য পাত্রের জায়গা (বর্গ সে.মি) |
২ |
২.৫ |
৩ |
প্রতিটি পাখির জন্য পানির পাত্রের জায়গা (বর্গ সে.মি) |
১ |
১.৫ |
২ |
পানি |
পর্যাপ্ত |
পর্যাপ্ত |
পর্যাপ্ত |
কোয়েলের রোগ ব্যবস্থাপনা ঃ কোয়েলের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি। তেমন কোনো রোগবালাই হয় না। সাধারণত কোনো ভ্যাক্সিন বা কৃমিনাশক ঔষধ দেয়া হয় না। অব্যবস্থাপনার কারণে কোয়েলের বাচ্চা মারা যায়, তবে পূর্ণবয়স্ক কোয়েলের মৃত্যু হার খুবই কম। এরা হঠাৎ আবহাওয়ার পরিবর্তন সহ্য করতে পারে না। তাই বিরূপ পরিবেশে কোয়েল পাখি নিম্মোক্ত রোগে আক্রান্ত হতে পারে-
১. রক্ত আমাশয় বা ককসিডিওসিস ঃ এ রোগ হলে কোয়েল ঘন ঘন পায়খানা করে, খাবার গ্রহণে অনীহা দেখা দেয় এবং শরীর স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে যায়। এক ধরনের ‘মাইটস’ এ রোগের জন্য দায়ি। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, থাকার জায়গা, খাবার জায়গা, খাবার ও পানি পানের পাত্রের জায়গা শুকনো ও পরিস্কার রাখতে হবে। রোগের প্রকোপ দেখা দিলে সালফার জাতীয় ঔষধ খাওয়ানো যেতে পারে।
২. ব্রুড-নিউমোনিয়া ঃ আবহাওয়া পরিবর্তনের সাথে সাথে বাচ্চা কোয়েল মারা যেতে পারে, যদি না ব্রুডারে থাকাকালীন অবস্থায় স্বাভাবিক তাপমাত্রা বজায় রাখা হয়। ‘এসপারজিলাস ফিউমিগেটাস’ নামক ছত্রাকের প্রভাবে এই রোগ হয়ে থাকে। নিউমোনিয়া হলে বাচ্চা পাখি ঝিমায়, দুর্বল হয়ে পড়ে ও খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেয়। জোরে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে থাকে, চোখ লাল হয়ে যায়, চোখ দিয়ে পানি পড়ে। এ অবস্থায় এন্টিবায়োটিক খাওয়াতে হবে। চিকিৎসা হিসাবে দুই গ্রাম ক্যালসিয়াম প্রোপিওনেট ১০০ কেজি খাবারের সাথে মিশাতে হবে।
৩. আলসারেটিভ ইন্টারাইটিস ঃ এটি কোয়েলের গুরুত্বপূর্ণ রোগ। পাতলা পায়খানা হয়, পাখি দুর্বল হয়ে পড়ে, খিঁচুনি হয়, ক্ষুদ্রান্ত্রে ও সিকামে ক্ষত দেখা যায়। চিকিৎসা হিসাবে খাবারের সাথে এন্টিবায়োটিক খাওয়াতে হবে।
শেষ কথা ঃ উৎপাদনের দিক থেকে কোয়েল অধিক উৎপাদনশীল। অন্যান্য পাখির তুলনায় কোয়েলের মাংস এবং ডিম গুণগতভাবে শ্রেষ্ঠ। কোয়েলের ডিমে কোলেস্টেরল কম এবং আমিষ বেশি। অল্প জায়গায় বাংলাদেশের আবহাওয়ায় অল্প খরচে পারিবারিক পর্যায়ে অথবা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কোয়েল পালন দেশের পুষ্টি ঘাটতি মিটাতে এবং জাতীয় আয় বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম।
কৃষির আরো খবর জানতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিনঃকৃষিসংবাদ.কম