বাঁচাতে হবে সুন্দরবনকে
সম্প্রতি শ্যালা নদীতে কার্গো ডুবে সাড়ে তিন লাখ লিটার ফার্নেস তেল ছড়িয়ে পড়ে সুন্দরবনের মহাসর্বনাশ ঘটিয়েছে। ভারী এই তেলের কারণে নদী ও বনের প্রাণী-পরিবেশ মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। তেলের কারণে পানির ভেতর মাছের ডিম, রেণু পোনা, জলজ প্রাণ ধ্বংস হয়ে গেছে। আগামীতে এর প্রভাব গিয়ে পড়বে খাদ্যচক্রে, ফলে এসবের ওপর নিভর্রশীল কুমির, ডলফিন, শূকর, হরিণসহ সুন্দরবনের গোটা জীববৈচিত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। এমনকি কুমির ও ডলফিন এ অঞ্চল থেকে সরে যেতে পারে। ফার্নেস তেলের ক্ষতির প্রভাব সুন্দরবনের ৫০০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। গত ১১ ডিসেম্বর শ্যালা নদীতে তেল ছড়িয়ে পড়ার প্রভাব সুন্দরবনে কী হতে পারে, এ নিয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের এক গবেষণায় এমন ভয়ংকর তথ্য উঠে এসেছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, তেল নিঃসরণের ফলে সুন্দরবনের জীববৈচিত্রে ভয়ংকর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। পানির ভেতরে ফার্নেস তেলের কারণে পানিতে ফাইটো প্ল্যাংটন বা উদ্ভিদকণা ও প্রাণীকণার মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। এর ফলে পানির ভেতর প্রাথমিক খাদ্যস্তর ভেঙে পড়েছে। ৩৪টি বেনথস (ইঊঘঞঐঙঝ) প্রজাতির ব্যঙাচি সুন্দরবন অঞ্চলে পাওয়া যায়। কিন্তু তেল নিঃসরণের পর ২৬টি প্রজাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। লবণ পানির ওয়াটারলিলিগোড়া পচে সবগুলোই মারা গেছে। আশংকা রয়েছে সুন্দরবনের প্রাণ সুন্দরী গাছের বংশ বিস্তারে ব্যাপক ক্ষতি হবে। কারণ তেল আক্রান্ত অঞ্চলে সুন্দরী গাছের ফল নষ্ট হয়ে গেছে। তেল আক্রান্ত অঞ্চলের সুন্দরী ফলের ৯৫ শতাংশের ভ্রূণই নষ্ট হয়ে গেছে। প্রতি বর্গমিটারের ৯৫ ভাগ শাসমূলীয় উদ্ভিদের গায়ে তেলের কালো আস্তরণ পড়ে গেছে। ফলে এ ধরনের উদ্ভিদের শ্বসন ও শারীরিক বৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আক্রান্ত অঞ্চলে দুই ধরনের শৈবালের মধ্যে লাল শৈবালের ৯৫ শতাংশই মারা গেছে। এ ছাড়া বাদামি শৈবালের দুটি প্রজাতি আক্রান্ত অঞ্চল থেকে উজাড় হয়ে গেছে। আক্রান্ত অঞ্চলের পানিতে খরশোলা, পারসে, বাগদা ও হরিণা চিংড়ির ডিম ও রেণু নষ্ট হয়েছে। তেল ছড়ানোর পর একটিও মাডস্কিপার দেখা যায়নি। মাডস্কিপার মূলত পাখি, ভোঁদড় ও সাপের খাদ্য। তেল ছড়ানোর পর ঐ এলাকায় কোনো জীবিত কাঁকড়া ও জীবিত শামুক দেখা যায়নি। অসংখ্য মরা কাঁকড়া দেখা গেছে। শামুক মাছ, পাখি ও কুমিরের খাদ্য। শ্যালা নদী ও আশপাশের তেল আক্রান্ত অঞ্চলে ৩১ থেকে ৪৩ ধরনের মাছ পাওয়া যেত। তেল ছড়ানোর পর এ অঞ্চলের ওপর গবেষণায় পাওয়া গেছে ১০ থেকে ১৪ ধরনের মাছ। কুমিরের আনাগোনা কমে গেছে। তেল ছড়িয়ে পড়ার পর গবেষণা অঞ্চলের কোথাও মাস্ক ফিনপুট পাখিটি দেখা যায়নি। বিভিন্ন প্রজাতির পাখির বিচরণ কমে গেছে। শীতে এ অঞ্চলে অতিথি পাখির ঢল নামে। তবে তেল আক্রান্ত হওয়ার পর কোনো অতিথি পাখি দেখা যায়নি। সংকটে পড়েছে ভোঁদরের অস্তিত্ব। স্বাভাবিকভাবে প্রতি ঘণ্টায় ৫ থেকে ১০টি ডলফিনকে পানির ওপর উঠতে দেখা যায়। অথচ তেল আক্রান্ত অঞ্চলে কোনো ডলফিন, হরিণের দেখা মিলছে না। তেলের কারণে মাটির বুনট বা গঠনেও নেতিবাচক প্রভাবের আশংকা রয়েছে। মারা যাচ্ছে ডোরা সাপ আর গুই সাপ। বনমোরগ ও শুকুরের দেখা মিলছে না।
আমরা মনে করি পৃথিবীর অন্যতম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি সুন্দরবনকে বাঁচাতে হলে অবিলম্বে শ্যালা নদীর নৌরুটটি বাতিল করতে হবে। এর পাশাপাশি কোনোভাবেই সুন্দরবনের কোনো স্থান দিয়েই তেলবাহী ও কয়লাবাহী কোনো জাহাজ নেওয়া যাবে না। তেলের চেয়ে কয়লা বেশি ক্ষতিকর। যদি কোনো কয়লাবাহী জাহাজ এখানে ডুবে যায়, তার ক্ষতি কোনোভাবেই সুন্দরবন কাটিয়ে উঠতে পারবে না বলেও বিষেশজ্ঞ মহল মনে করেন।
২. আসছে ঈসায়ী নববর্ষ ২০১৫ সাল। পুরাতন বছরের যত গ্লানি কেটে যাক সবার জীবন থেকে। বয়ে যাক মুক্তির অমিয় ধারা সকল প্রাণে প্রাণে। আমাদের সকল পাঠক, লেখক, বিজ্ঞাপনদাতা ও শুভানুধ্যায়িদের নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাই।